ব্যর্থতার ভয় মানুষের বড় লক্ষ্য পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। অনেকেরই জীবনে বড় কিছু করার স্বপ্ন থাকে। কিন্তু বেশিরভাগই সেই স্বপ্ন পূরণ করার কাজই শুরু করতে পারে না। কারণ, ব্যর্থ হওয়ার ভয়। স্বপ্ন পূরণের পথে পা বাড়ানোর কথা ভাবলেই অনেক সময়ে মনে হয়: “আমার যথেষ্ঠ টাকা নেই”, “যথেষ্ঠ শক্তি নেই”, ”মেধা নেই” – ইত্যাদি।
এইসব নেতিবাচক বা নেগেটিভ চিন্তা কাজই শুরু করতে দেয় না। কাজ শুরু করার আগেই ব্যর্থ হওয়ার চিন্তা মানুষকে ব্যর্থ হওয়ার আগেই ব্যর্থ করে দেয়।
ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে উঠে সাফল্য পাওয়ার ৪টি উপায়:
০১. নিজের দুর্বলতা গুলোকে আপন করে নিন
বেশিরভাগ মানুষ নিজের দুর্বলতা অথবা খারাপ দিকগুলো নিয়ে ভাবতে চায় না। কিন্তু এগুলো নিয়ে না ভাবলে আসলে এগুলো ভালোমত বোঝা যায় না। এবং বোঝা না গেলে সেগুলো ঠিকও করা যায় না। আর যতক্ষণনা আপনি নিজের দুর্বলতা গুলো স্পষ্ট করে জানছেন, এবং সেগুলো দূর করার জন্য কিছু করছেন – ততক্ষণ সেগুলো আপনাকে আরও দুর্বল করবে। কোনও বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে গেলে এগুলো দু:শ্চিন্তার সৃষ্টি করবে। যার ফলে আপনি বেশি বেশি ব্যর্থ হওয়ার ভয় পাবেন।
কাজেই, আপনার যদি মনে হয় আপনি অল্পতে রেগে যান, বা অল্পতে ভয় পান – তবে যুক্তি দিয়ে এইসব ধারণা বাতিল করার বদলে এগুলো নিয়ে চিন্তা করুন। কেন আপনি এমনটা করেন – তা বোঝার চেষ্টা করুন। নিজের দুর্বলতাগুলো নিজের অংশ হিসেবে মেনে নিন। তারপর এগুলো দূর করার চেষ্টা করুন। হতে পারে আপনার পড়া মনে রাখতে না পারার দুর্বলতার পেছনের কারণ, আপনি আসলে যথেষ্ঠ সময় নিয়ে পড়েন না। অথবা পড়ার সময়ে অন্য চিন্তা করেন।
দুর্বলতা নিয়ে চিন্তা করলে, সেগুলোর পেছনের কারণ, এবং সমাধান বের হয়ে আসে। প্রয়োজনে বিশ্বস্ত বন্ধুর সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে নিজের বাবা-মা বা তেমন কারও কাছে নিজের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলুন, এবং তাদের কাছে পরামর্শ চান। এটা আপনি যতটা ভাবছেন, তারচেয়েও বেশি উপকার করে।
বেস্ট সেলিং লেখক ও বিশ্বের সেরা একজন সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ সাইমন সিনেক একবার বলেছিলেন, “সাহায্য ও পরামর্শ দেয়ার জন্য যোগ্য মানুষ বসে আছে। সমস্যাটা আমাদের আমরা নিজের দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়ে অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে যাই না।”
নিজের দুর্বলতাগুলো মেনে নিন, তারপর সেগুলো দূর করার চেষ্টা করুন। নিজে যতটা পারেন করুন, তারপর অন্যের সাহায্য নিন। নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেলে ব্যর্থতার ভয় অনেক কমে যাবে। কারণ আপনি জানবেন, আপনি আসলেই কোন বিষয়ে কতটা দুর্বল, এবং সেই দুর্বলতা মোকাবেলা করার উপায়ও আপনার জানা থাকবে।
০২. দরকার হলে পরিবেশ ও সঙ্গ বদলে ফেলুন
অনেক সময়েই আমাদের আশপাশের মানুষ ও পরিবেশ আমাদের ভালো চিন্তা করতে বাধা দেয়। পৃথিবীর প্রায় সব সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোচ একটা কথাই বলেন, নেতিবাচক মানুষদের এড়িয়ে চলতে হবে। যদি দেখেন আপনার কোনও বন্ধু বা আত্মীয় সবকিছু নিয়ে অভিযোগ করে। অথবা সব ব্যাপারে নিরাশ থাকে – তবে তার সাথে সম্পর্কের ধরন বদলে ফেলুন। খুব প্রয়োজন না হলে এসব মানুষের সাথে যোগাযোগ করবেন না। এবং তাদের কথাকে গুরুত্ব দেবেন না। এই ধরনের মানুষ নিজেরাও আশা করতে পারে না, অন্যদেরও নিরাশ করে দেয়। এদের সাথে থাকতে থাকতে সহজ বিষয়েও ব্যর্থতার ভয় মনে ঢুকে যায়। অতিরিক্ত নেগেটিভ মানুষ কারও কোনও উপকারে আসে না – এদের এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটু চিন্তা করলেই হয়তো বুঝতে পারবেন, কোন কোন লোকের কাছে গেলে আপনি বেশি হতাশ হন। কারা সব সময়ে নেতিবাচক থাকে। এই লোকদের যত পারুন এড়িয়ে চলুন। তার বদলে ইতিবাচক ও আশাবাদী মানুষের সাথে বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। এই ধরনের মানুষ অন্যদের সব সময়ে অনুপ্রেরণা দেন। তাঁরা নিজেরা যেমন পজিটিভ থাকেন, তাঁদের আশপাশের মানুষকেও পজিটিভ রাখার চেষ্টা করেন।
এছাড়া যদি অগোছালো ভাবে থাকেন, তবে একটু গুছিয়ে থাকার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন সকালে উঠে নিজের বিছানা নিজে গোছান। ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো থাকলে গুছিয়ে রাখার অভ্যাস করুন। আপনি যতটা ভাবছেন – এটা তারচেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাস জাগায়। নিজের চারপাশের মানুষ ও পরিবেশ বদলে ফেললে দেখবেন – যে কোনও কাজে আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন।
০৩. চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করুন
পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। একদল তাদের চিন্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আরেকদল নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যারা নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে – তারাই আসলে যে কোনও নেতিবাচক বা নেগেটিভ চিন্তাকে পজিটিভ চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তায় পরিনত করতে পারে। আর এরাই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে পারে।
মানুষের মাথায় নেতিবাচক চিন্তা আসবেই। কিন্তু এগুলোকে ইতিবাচক চিন্তা দিয়ে বদল করতে হবে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক, সোহাগ ও সুমন দুই ভাইয়ের কেউ সাঁতার জানে না। তাদের এক মামা তাদের সাঁতার শেখাতে পুকুরে নিয়ে গেলেন। পুকুরের কাছে গিয়ে দুই ভাইয়েরই মনে হল তারা ডুবে যাবে। সোহাগ কিছুতেই এই নেতিবাচক চিন্তা থেকে বের হতে পারলো না। অন্যদিকে সুমন ডুবে যাওয়ার চিন্তার পাশাপাশি এটাও ভাবলো যে, অন্যরা যদি সাঁতার শিখতে পারে, তবে সে-ও চেষ্টা করলে পারবে। এই চিন্তা করে সে পানিতে নামলো। সুমন কয়েক দিনের মধ্যেই সাঁতার শিখে গেল। অন্যদিকে সোহাগ পানিতেই নামতে পারলো না।
সুমনের সফল হওয়ার কারণ, সে ব্যর্থতার ভয় সত্বেও একটি পজিটিভ চিন্তা করতে পেরেছিল। এই চিন্তা তাকে আশাবাদী করেছিলো, এবং সে চেষ্টা করেছিলো।
আপনি ছোট-বড় সবকিছু করতে গেলেই নেগেটিভ চিন্তার শিকার হবেন। কিন্তু চেষ্টা করলে সেই বিষয়ে পজিটিভ অনেক কিছুও চিন্তা করতে পারবেন। আর এর জন্য নিজের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা থাকতে হবে।
খুব সহজ একটা জিনিস প্রাকটিস করে আপনি এই ক্ষমতা বাড়াতে পারেন। মূল ব্যাপারটা হল নিজের ইচ্ছায় নিজের মনকে একটি চিন্তা থেকে আরেকটি চিন্তায় নিতে পারা। আমরা সব সময়েই চিন্তার ভেতরে থাকি। মাঝে মাঝে অটোমেটিক চিন্তা থেকে নিয়ন্ত্রিত চিন্তা করার প্রাকটিস করুন। মনে মনে একটি দৃশ্য কল্পনা করে নিন। যে কোনও দৃশ্য হতে পারে। একটি খালি রুমের মধ্যে একটি খালি চেয়ার, অথবা আপনার মায়ের মুখ, আপনার দেখা কোনও মনোরম দৃশ্য – যে কোনও কিছু হতে পারে।
যে কোনও অন্য চিন্তা করার সময়ে ইচ্ছা করে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে এই নির্দিষ্ট দৃশ্যটি কল্পনা করুন। যে কোনও সময়ে এটা প্রাকটিস করতে পারেন। এতে করে নিজের ইচ্ছায় নিজের চিন্তাকে পরিবর্তন করার প্রাকটিস হবে। এটা কিছুদিন প্রাকটিস করলে, কোনও নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসলে তা ইতিবাচক কল্পনা দিয়ে বদলে নিতে পারবেন। যখনই মনে হবে কোনও কাজের ফলাফল হবে ব্যর্থতা, জোর করে আপনি সেই ব্যর্থতার চিন্তাকে সাফল্যের চিন্তা বানিয়ে নিতে পারবেন। কারণ, আপনার মস্তিষ্ক আপনার ইচ্ছামত চিন্তা পরিবর্তন করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। বিশ্বাস না হলে কয়েকদিন এটা প্রাকটিস করেই দেখুন। নিজেই নিজের মধ্যে একটা নতুন ক্ষমতা টের পাবেন।
০৪. নিজের ভালো গুণগুলোকে কাজে লাগান ও আরও ধারালো করুন
প্রতিটি মানুষেরই কিছু ভালো গুণ আছে। আপনি হয়তো খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, অথবা খুব দ্রুত লিখতে পারেন, নতুন নতুন আইডিয়া ভাবতে পারেন – ইত্যাদি। আপনার ভালো গুণ যেগুলোই হোক না কেন – সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দিন। সেগুলোকে আরও ভালো করার জন্য সেসব বিষয়ে নতুন নতুন জিনিস শিখুন এবং নিয়মিত চর্চা করুন।নিজের লক্ষ্য অর্জনে সেই গুণকে কিভাবে কাজে লাগাবেন – তা চিন্তা করুন। আপনার সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা নতুন বিজনেস ডিল পেতে, বা চাকরির ইন্টারভিউয়ে ভালো করতে কাজে আসতে পারে।
নিজের গুণ গুলোকে আরও শানিত করা আপনার আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দেবে। আর আত্মবিশ্বাস যত বাড়বে – ততই আপনি বড় বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সাহস পাবেন। ব্যর্থতার ভয় দিনে দিনে কমে যাবে।